আহ্বানঃ কুড়িগ্রামবাসীর প্রতি

হাত বদল হচ্ছে পৃথিবীর অধিকার, তবু- ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না আমাদের। কুড়িগ্রাম জেলা বলে কথা। এখানকার ঊর্বরতার প্রধান সহায়ক এখন লাঙ্গল। লাঙ্গলের আবিষ্কারে পৃথিবীতে এক নূতন বিপ্লবের সুচনা ঘটেছিল। মানুষ শস্য উৎপাদন করে ক্ষুধামুক্ত হবার প্রচেষ্টায় দলে দলে নেমেছিল। ক্ষুধার কিছুটা লাঘবও হয়েছিল বটে। আমার ধারণা একমাত্র জীব- মানুষ-ই সৃজনশীল। আর এই সৃজনশীলতা নিয়ে মানুষ নূতন বিপ্লব সৃষ্টির নেশায় উদত্ত থাকতো। তারপর মানুষ একে একে আবিষ্কার করতে থাকলো চাকা, মটর, রেল, উড়োজাহাজ, রকেট থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।

তবু মানুষ ক্ষুধামুক্ত হতে পারল না। বরং ক্ষুধা, সৃষ্টির সমানুপাতে বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। মানুষের আদিকালের পেটের ক্ষুধা এখন অতি-আধুনিক যুগে এসে রুপ নিয়েছে- মনন,শারীরিক, দৈহিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষুধাতে। তাই ক্ষুধার্ত মানুষের এক টালমাতাল এখনকার এই অত্যাধুনিক বিশ্ব। আদিম কালের অজ্ঞতা ক্রমে পুঁজিবাদের দিকে যেমন প্রবহমান ছিল, ঠিক আজ সেই পুঁজিবাদ যথেষ্ট ক্ষমতার ভারে নব্য ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়েছে। এখন মানুষ তুরি দেবার ক্ষমতা পেলেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। যেন বসতে পেলে ওঠবার উচিত্যকে ভুলে বসে।

ডারউইন কর্তৃক প্রদত্ত- বিবর্তনবাদ মিথ্যা হলেও মানুষের মানবিকতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যথার্থ বিবর্তন ঘটেছে তা দিনের আলোর মত উজ্জ্বল। বিবর্তন ঘটছে বিশ্বের সর্বত্র। বিবর্তনের চোটে ধনীকশ্রেণীর হাতে চরমভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে সম্পদহীন, বলহীন নিঃস্ব, দুস্থ, অসহায় নিচুতলার মানুষগুলো। একটি দেশের একদিকে নিয়ন আলোয় উদ্ভাসিত। আর অন্যদিকটায় অন্ধকার। যেন সেই ঝকমকে পরিপাটি বর্ণীল মানুষগুলো এই পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষ নয়। হয়ত তারা এসেছে কোন এক আভিজাত্য গ্রহের থেকে। কাজ শেষে আবার ঘরে ফিরবে। পাপ, পঙ্কিলতা তাদের ছুঁতে পারে না। অপরদিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রাণিগুলো যেন ইতর বিশেষ। তাদের ধর্ম নেই, কর্ম নেই, জাত নেই। নেই, নেই- তাদের কিছুই নেই।

আজকের যে সামাজিকতার কথা আমরা শুনি তা ঐ নিয়ন আলোয় উদ্বেলিত মানুষগুলোর হাতে তৈরি। এই সামাজিকতায় অন্ধকারের মানুষগুলো কেবল অবজ্ঞার পাত্র তাই নয়, বরং তার চেয়েও অনেক বড় কিছু। তাদের মাথাগুলোকে চিরদিনের জন্য দাবিয়ে রাখার প্রথম পদক্ষেপ আজকে অর্থহীন সামাজিকতা। এরপর ক্রমে তাদের ক্ষীণ, দুর্বল শরীরগুলোতে আঘাত হানতে থাকল রাজনীতি, অর্থনীতি। শোষিত, বঞ্চিত, উপেক্ষিত নিচু তলার মানুষগুলোর মুষ্টিবদ্ধ হাত আজ মিছিলে, সমাবেশে দৃশ্যত হয়। তাদের চাপিয়ে রাখা ক্ষোভ আজ উন্মত কণ্ঠে রাজপথ প্রকম্পিত করতে দেখা যায়। তাদের ত্যজদীপ্ত রক্তের স্রোত বয় পৃথিবীর বুকে। তবু মানুষগুলো চলমান। মানুষগুলোর উড্ডীন মস্তক দৃশ্যমান। যেন এক-একটি মুক্তিকামী সংসপ্তক। তবু মানুষগুলো অধিকার চায়। সাম্য চায়। শ্রেণিহীন সমাজ চায়। বিপ্লব আনে। বিপ্লব গড়ে। বিপ্লব করে। ওদেরকে দাবায় রাখা যাবে না।

ঠিক এমন অধিকার আদায়ের সন্ধিক্ষণে কুড়িগ্রামবাসী গুহার ভিতরে বর্তমান। যেন তাদের অধিকারের প্রয়োজন নেই। তাদের সাম্যের প্রয়োজন নেই। তাদের শ্রেনিহীন সমাজের প্রয়োজন নেই। তাদের বুক দলিত করে চিতার বন্দবস্ত যে করে, তাদেরকেই তারা বেশি ভালোবাসে। তারা কখন মুক্তি চায় না। তারা কখন মুক্তি চায় না। ভবানীপাঠক, ফকির মজনু শাহা, নুরুলদ্দীনের মত বীরপুরুষের জন্ম এই উত্তাঞ্চল তা ভাবতে অবাক লাগে আজ। আজ যে মানুষ নামের অন্ধকারের প্রাণী দেখছি, তার সবগুলো মৃত, তার সবগুলো রক্তহীন শীতল প্রাণী। যখন কুড়িগ্রামের মুক্তি তথা কুড়িগ্রামবাসীর মুক্তির জন্য বিপ্লব প্রয়োজন তখন চোখ ধাঁধানো নিয়ন আলোর খোলস পড়ানো পেতাত্মার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। তাই আসুন আন্দোলন করি। বিপ্লব করি। বিপ্লব আনি। হাত বদল হচ্ছে পৃথিবীর অধিকার। ভাগ্য বদলাতে হবে নিজেদের পরিশ্রমে।

Comments

Popular posts from this blog

কুড়িগ্রামে সুবিমল মিশ্র, সন্দীপ দত্ত ও শাহেদ শাফায়েতের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত

মিজান খন্দকার সাহিত্য পুরস্কার’ পাচ্ছেন কবি শামীম সৈকত

মোকলেছুর রহমানের নতুন কবিতার বই ‘সব বৃক্ষ মহোদয় হয় না’