কুড়িগ্রাম নিয়ে আমার অভিমত

লিখেছেন- আনু ইসলাম

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘খানা আয় ব্যয় জরিপ’-২০১৪ এবং ২০১৬ সালে দারিদ্র্যে শীর্ষ জেলাঃ কুড়িগ্রাম। বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত ২২৪৫.০৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তন এবং ছোট বড় মিলে মোট ১৬টি নদনদী নিয়ে গড়ে উঠেছে এই জেলাটি। যার মোট নদী পথের দৈর্ঘ্য ১৪৭.২০ কিলোমিটার। উক্ত জেলায় প্রবাহমান মূল ধারার নদনদীগুলো- ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধরলা, দুধকুমার এবং তিস্তা। নদী অববাহিকায় গড়ে উঠা এই জেলাটির ৯টি উপজেলার, ৩টি পৌরসভা ও ৭৩টি ইউনিয়নে ২০.৬৯ লাখের অধিক মানুষের বসবাস। মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৪লাখ মানুষ ৬০-৬৫টি ইউনিয়নের ৪৫০টি চরে মানবেতর জীবন যাপন করে। কুড়িগ্রাম জেলায় শিক্ষার গড় হার ৫৬.৪৫ শতাংশ, যা বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য বড় লজ্জার বিষয়। কুড়িগ্রামের বৃহৎ জনগোষ্ঠি কৃষির উপর নির্ভরশীল। এই জনগোষ্ঠির আয়ের ৭০.৪১ শতাংশই আসে কৃষি থেকে। বর্তমান জেলাটির মোট আবাদী জমির পরিমাণ ১,৬৭,৪৬৭ হেক্টর। যা বর্না ও নদী ভাঙ্গনের ফলে দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে বৃহত্তর এই জনগোষ্ঠি ধাবিত হচ্ছে চরম এক সংকটের দিকে।


নদী ভাঙ্গন বাংলাদেশের একটি স্থায়ী ও পুনঃসংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নদী যত পরিণত পর্যায়ে এগোতে থাকে (যেমন তিন প্রমত্ত নদী- ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনার ক্ষেত্রে ঘটেছে) ততই সেগুলি মন্থর ও বিসর্পিল (আঁকাবাঁকা) আকৃতির হতে থাকে, নদীর এই দোলন নদীতীরের ব্যাপক ভাঙ্গন সংঘটিত করে। যার বাস্তব দৃশ্য- কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণে প্রবাহমান ব্রহ্মপুত্র, ব্রহ্মপত্রের শেষ প্রান্ত থেকে বিস্তর দক্ষিণে প্রবাহমান যমুনা, খাড়া উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহমান ফুলকুমার এবং উত্তর-পশ্চিম হতে পূর্ব-দক্ষিণে প্রবামান ধরলা ও তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে ফুটে উঠে। 

প্রতি বছর নদী ভাঙ্গনের কারণে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষেতের ফসল, ফসলি জমি ও বসতভিটা নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যায়।
 

অনাদিকাল থেকে জেলাটির ৯টি উপজেলায় নদী ভাঙ্গন ও বন্যার দূর্ভোগ যেন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৭টি উপজেলা সর্বাধিত ক্ষতিগ্রস্ত। নদী ভাঙ্গনের আর্থ-সামাজিক প্রভাব মারাত্মক। উলে­খ্য যে, অধিকাংশ নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন একে প্রাকৃতিক ঘটনা হিসাবে ধরে নেয়। অনেকে আবার দোয়া-মানৎ ইত্যাদির শরনাপন্ন হয়। আজ কুড়িগ্রামের জাতীয় দারিদ্র্যের বড় কারণ এই নদী ভাঙ্গন।


সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নদী ভাঙ্গনের কারণে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং বিপদাপন্ন লোকের সংখ্যা আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিঃস্ব, রিক্ত ও সর্বশান্ত মানুষ ভূমিহীনের কাতারে সামিল হয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেলাটিতে প্রতি বছর প্রায় ৪০হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়। প্রায় ৯হাজার গৃহহীন পরিবার উন্মুক্ত আকাশের নীচে, পথের পাশে, বাঁধে, ফুটপাত ও সরকারের খাস জমিতে এসে আশ্রয় নেয়। নদীতীরবর্তী অঞ্চলে ভাঙ্গনের ফলে গ্রামীন কৃষিকাজ দারুনভাবে ব্যাহত হয়। বসত ভিটার  সঙ্গে কৃষিজমি, অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। ফলে বিপন্ন জনগোষ্ঠির কৃষি আয় দারুনভাবে কমে আসে। বড় বড় কৃষকরা এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পর মাঝারি কৃষক ও প্রান্তিক চাষির দল। ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা সম্পদ হারিয়ে জমানো সঞ্চয়ের উপর হাত বাড়ায় এবং প্রায়শই নতুন ঋণে জড়িয়ে পরে। সুযোগে এনজিও এবং চরা সুদের প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের বোঝা তুলে দেয় অসহায় এই জনগোষ্ঠির উপর। গবেষকদের মতে ভাঙ্গনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া ভূমির পরিমাণ নদীর তলদেশ  থেকে জেগে উঠা নতুন ভূমির পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি। এ নদী পয়স্তি ও নদী সিকস্তি ঘটনা জেলাটির নদী গতি পথ ব্যবস্থার একটা বৈশিষ্টপূর্ণ বৈচিত্র, যা স্থানীয় রাজনীতির জন্ম দেয়। সঙ্গত কারণেই ‘কুড়িগ্রাম জেলা’ আজ বাংলাদেশে শীর্ষ দারিদ্র্যের অংশীদারি। তাই বাংলাদেশ সরকার এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন এই যে, নদী ভাঙ্গন ও বন্যা কবলিত সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল চিহ্নিত করে সেখানে কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষিজমি রক্ষাপূর্বক এই উপেক্ষিত জনগোষ্ঠির দারিদ্র্য বিমোচন করতঃ জনগোষ্ঠির উন্নয়নের রাস্তা সুগম করে দিতে একান্ত মর্জি হয়।

Comments

Popular posts from this blog

কুড়িগ্রামে সুবিমল মিশ্র, সন্দীপ দত্ত ও শাহেদ শাফায়েতের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত

মিজান খন্দকার সাহিত্য পুরস্কার’ পাচ্ছেন কবি শামীম সৈকত

মোকলেছুর রহমানের নতুন কবিতার বই ‘সব বৃক্ষ মহোদয় হয় না’